এখনই শেয়ার করুন।

অভিষেক ঘোষ,মালবাজার, :- প্রায় ১৫০ বছর আগে ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাজ করতো ভুটানের রাজ পরিবার। সেই সময় হিন্দু এবং বৌদ্ধ ভাবধারার সংমিশ্রণে মেটেলী এলাকায় শুরু হয় দক্ষিণা কালীর পুজো। ‌ এখনো প্রতিবছর সম্পূর্ণ নিয়ম আচার মেনে কালীপুজো হয় মেটেলী কালীবাড়িতে। একসময় পশু বলি প্রথার প্রচলন থাকলেও বেশ কয়েক বছর যাবৎ বন্ধ হয়েছে বলি প্রথা। এই কালীবাড়ির অদ্ভুত দর্শন কষ্টি পাথরের কালী মূর্তির মতো অন্য কোনো মূর্তি এই এলাকায় দেখা যায় না। ড্রাগনের মতো টানা টানা চোখ দেখে মনে হয় বৌদ্ধ ধর্মের ছোঁয়া রয়েছে এই মূর্তি নির্মাণে। এই মূর্তি ঠিক কতটা প্রাচীন তা সঠিকভাবে বলতে পারেন না কেউ।

ইতিহাসের বিভিন্ন গবেষণা পত্র থেকে জানা গিয়েছে, ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশদের পদচারণা হয়েছিল এই ডুয়ার্সের মাটিতে। সিনচুলা চুক্তির মাধ্যমে ভুটান রাজ পরিবারের দখলে থাকা ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের দখলে নেয় ব্রিটিশরা। যদিও তারপরেও বেশ কয়েক বছর ডুয়ার্সের বিভিন্ন এলাকা ভুটান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। সম্ভবত সেই সময়কালে ভুটানের রাজা জিগমে নামগেয়াল -এর আদেশেই মেটেলী এলাকায় তৈরি হয় কালী মন্দির। সেই সময় টিনের তৈরি কালী মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এই কষ্টি পাথরের মূর্তি টি। পরবর্তীতে ১৮৬৫ সালের এক ঝড়ের রাতে একটি গাছ পড়ে সম্পূর্ণ ভেঙে যায় কাঁচা মন্দিরটি। স্থানীয় বাসিন্দারা মিলে পুনরায় পাকা মন্দির তৈরি করার পরিকল্পনা করেন । সেই পরিকল্পনা মাফিক ৬৪ ডেসিমেল জমির ওপর মন্দির তৈরির জন্য খননকার্য শুরু হয়। খনন শুরু হতেই একের পর এক প্রাচীন নিদর্শন উদ্ধার হয়। বাংলায় ১২৭৮ বঙ্গাব্দ লেখা একটি ফলক বেরিয়ে আসে মাটির তলা থেকে। ১৩৩০ বঙ্গাব্দ খোদাই করা একটি খাড়া পাওয়া যায় খনন কার্যের সময়। সেই খাড়া দিয়েই পরবর্তীতে কালীপুজোর রাতে পশু বলি দেওয়া হতো।

শুধুমাত্র ব্রিটিশ ভারত অথবা ভুটান রাজ পরিবারের ইতিহাসের সাক্ষী নয় এই কালীবাড়িটি। মেটেলী কালীবাড়ির সাথে নিবিড় সম্পর্ক ছিল সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ভবানী পাঠকের। খনন কাজের সময় মেটেলী কালীবাড়ির একটি অংশে গোপন সুরঙ্গ আবিষ্কার হয়। স্থানীয়রা মনে করেন সেই সুরঙ্গ ব্যবহার করেই বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল থেকে মেটেলী কালীবাড়িতে মায়ের আরাধনা করতে আসতেন স্বয়ং ভবানী পাঠক। জনসাধারণের জন্য সেই সুরঙ্গ পথ আপাতত বন্ধ করা আছে। খননকাজের সময় উদ্ধার হওয়া ফলক দেখেই স্থানীয়দের অনুমান মন্দিরের মূর্তি অন্ততপক্ষে ১৫৯বছর পুরনো। পরাধীন ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ সাহেবরা মেটেলী আসতেন মা কালীর দর্শন করতে। বর্তমান সময়ে দীপান্বিতা অমাবস্যার পূজোয় পশু বলি প্রথা সম্পন্ন নিষিদ্ধ । তবে ভাটা পড়েনি কালী পূজোর আয়োজনে। প্রসঙ্গত, এই কালিবাড়ীর স্থায়ী ঠাকুর দালানে প্রতি বছর শারদীয়া দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়। মেটেলীর স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, হেরিটেজ ঘোষণা করা হোক শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরকে।

মেটেলী কালীবাড়ির মন্দির কমিটি সভাপতি দিলীপ গুহ রায় বলেন, অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মায়ের আরাধনা করা হয় এখানে, সারা বছর ভক্তের ঢল থাকলেও কালী পূজোয় তিলধারণের জায়গা থাকে না। কমিটির সম্পাদক বিশ্বজিৎ মন্ডল বলেন, মন্দিরের সঠিক ইতিহাস উদ্ঘাটন করতে উচ্চ পর্যায়ের গবেষণা প্রয়োজন। মালবাজার পরিমল মিত্র স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক স্বপন কুমার ভৌমিক বলেন, কার্বন ডেটিং পরীক্ষার মাধ্যমে মূর্তির সঠিক বয়স নির্ধারণ সম্ভব, তবে সেই বিষয়ে মন্দির কমিটিকে উদ্যোগ নিতে হবে। মেটেলী পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি বিদ্যা বারলা বলেন, মন্দির কে হেরিটেজ ঘোষণার বিষয়ে প্রশাসনিক ভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করবো।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *